বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ

অষ্টম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - | NCTB BOOK

প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া সব বস্তুকেই প্রাকৃতিক সম্পদ বলা হয়। মানুষ প্রকৃতি থেকেই এসব সম্পদ আহরণ করে। এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের অগ্রগতি ঘটে। প্রাকৃতিক সম্পদ পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব ।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
•বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ যথা: বনজ, জলজ, কৃষিজ, খনিজ, মৎস্য ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
• বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারব,
• বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের বর্ণনা করতে পারব ;
• বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্প যেমন- পাট, বস্ত্র, চিনি, সিমেন্ট, ঔষধ, গার্মেন্টস, চিংড়ি, চা, চামড়া, তুলা, তামাক ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব ;
• বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসব শিল্পের অবদান ব্যাখ্যা করতে পারব; • জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এগুলো সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করব।

Content added || updated By

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ

প্রকৃতির মধ্যে নানা মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। যেমন পানি, বায়ু, মাটি, গাছপালা, জীবজন্তু, ফসল, খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি । এসব প্রাকৃতিক বস্তুকে মানুষ নিজেদের চাহিদা মতো রূপান্তরিত করে ও কাজে লাগায়।

নিচে আমরা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে আলোচনা করব :

১. মাটি : মাটি বাংলাদেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এদেশের সমতল ভূমি খুবই উর্বর বেশির ভাগ এলাকায় বছরে তিনটি ফসল উৎপন্ন হয়। দেশের ১০ ভাগের এক ভাগ অঞ্চল পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ে প্রচুর প্রাণিজ, বনজ ও খনিজ সম্পদ রয়েছে।

২. নদ-নদী : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে ছোট-বড় অনেক নদী আছে। নদীগুলো মালামাল পরিবহনের সহজ মাধ্যম। নদীর পানি প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এছাড়া বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে আমাদের নদ-নদীতে।

৩. খনিজ সম্পদ : বাংলাদেশের মাটির নিচে রয়েছে নানা রকম মূল্যবান খনিজ সম্পদ। এগুলোর মধ্যে কয়লা, গ্যাস, চুনাপাথর, চিনামাটি, সিলিকা বালি উল্লেখযোগ্য ।বাংলাদেশের মাটির নিচে রয়েছে নানা রকম মূল্যবান খনিজ সম্পদ। এগুলোর মধ্যে কয়লা, গ্যাস, চুনাপাথর, চিনামাটি, সিলিকা বালি উল্লেখযোগ্য।

৪. বনজ সম্পদ : বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৪,৯৩৮ বর্গকিলোমিটার। দেশের মোট ভূ- ভাগের ১৬ ভাগ হচ্ছে বন। বনে রয়েছে মূল্যবান গাছপালা । এগুলো আমাদের ঘরবাড়ি ও আসবাব তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বনে রয়েছে পাখি ও প্রাণিসম্পদ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের আরও বেশি অর্থাৎ ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন।

৫. মৎস্য সম্পদ : বাংলাদেশে অনেক নদ-নদী, খাল-বিল ও দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর রয়েছে। এসব খাল-বিল, নদ-নদীতে রয়েছে প্রচুর মিঠা পানির মাছ। এছাড়া সামুদ্রিক মাছও আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছে । মাছ ধরে বহু মানুষ জীবিকা অর্জন করে।

৬. প্রাণিসম্পদ : আমাদের প্রাণিসম্পদের মধ্যে রয়েছে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি । এগুলো গৃহপালিত প্রাণী। এছাড়াও রয়েছে নানা প্রজাতির প্রচুর পাখি।
৭. সমুদ্রসম্পদ : বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল জুড়ে বঙ্গোপসাগর। সাগর তীরে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর। সাগরের পানি থেকে আমরা লবণ উৎপন্ন করি। তাছাড়া সাগর থেকে আহরণ করি প্রচুর মাছ । 

এগুলোই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। যদিও জনসংখ্যার তুলনায় কোনো কোনো সম্পদ যথেষ্ট পরিমাণে নেই। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এগুলো ব্যবহার করতে পারলে সীমিত সম্পদ দিয়েই দেশ সমৃদ্ধ হতে পারে।

কাজ : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের তালিকা তৈরি করো। এসব সম্পদ আমাদের জীবনকে কীভাবে সমৃদ্ধ করছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন লেখ।

Content added By

আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের ভূমিকা

বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নানা রকম কাজ করে। এসব মানুষের অর্থনৈতিক কাজ। এই অর্থনৈতিক কাজের উপর ভিত্তি করেই সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে।

প্রাচীনকালে মানুষ বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ করত এবং পশু শিকার করে তার মাংস খেতো। তারপর তারা ফসল ফলাতে শেখে এবং কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করে। খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগকে কেন্দ্র করেই মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত মানুষ যেসব সম্পদ ব্যবহার করেছে তার সবটাই ছিল প্রাকৃতিক । প্রাকৃতিক সম্পদকে রূপান্তর করে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করেছে। আধুনিককালে মানুষ কয়লা, লোহা, পাথর, স্বর্ণ, রৌপ্য, গ্যাস ইত্যাদি খনিজ পদার্থ উত্তোলন করতে শিখেছে। তারা প্রকৃতির সম্পদকে আরও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করছে। এর জন্য তৈরি করছে অনেক আধুনিক যন্ত্র। এভাবেই মানুষ নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে দ্রুত উন্নত করেছে।

বাংলাদেশের উন্নতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের ভূমিকা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। অন্যদিকে সম্পদের তুলনায় দেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। এজন্য যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে হবে।

উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। এদেশের মাটি খুব উর্বর। এই উর্বর মাটি যথাযথভাবে ব্যবহার করলে কৃষি উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে শিল্পায়নও করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়বে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে গ্রামে। ফলে কাজের জন্য তখন আর গাঁয়ের লোক শহরের দিকে ছুটবে না ।

সুষম খাদ্যের অভাব পূরণ : বর্তমানে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি ও মৎস্য এই তিন ধরনের প্রাণিজ সম্পদেরই ব্যবহার বেড়েছে। এর ফলে সুষম খাদ্যের অভাব পূরণ হচ্ছে। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ খামার সৃষ্টির ফলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ।

সেচ সুবিধা প্রদান : নদী-খাল-বিল হাওরের পানি দিয়ে আমরা কৃষি জমিতে সেচ দিতে পারি। ফলে শুকনো মৌসুমেও কৃষি উৎপাদন অনেক বাড়ানো যায় ।

শিল্পের উন্নয়ন ও ব্যবহার প্রসার : দেশের গ্যাস, কয়লা ও চুনাপাথর আমাদের জীবনযাত্রায় কাজে লাগছে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে এবং শিল্পের প্রসার ঘটছে।

বনজ সম্পদের ভূমিকা : বাড়িঘর তৈরি ও আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য আমরা বনজ সম্পদ ব্যবহার
করি। আবার প্রকৃতিতে তাপমাত্রা কমানোর জন্য বনজ সম্পদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে। এজন্য পরিকল্পিতভাবে আমাদের বনজ সম্পদ আরও বাড়াতে হবে।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করলে দেশের কৃষি-শিল্প যেমন উন্নত হবে তেমনি মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

কাজ : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কীভাবে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে?

Content added || updated By

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্য : প্রকৃতির মধ্যে সব রকমের জীব যে নিয়মে বেঁচে থাকে তাকেই সংক্ষেপে জীববৈচিত্র্য বলা যায়। মানুষ, প্রাণী ও কীট-পতঙ্গসহ জীবজগৎ প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই বেঁচে থাকে। জলবায়ু ও তাপমাত্রার নানা পরিবর্তনের ফলে জীবজগতের বিভিন্ন প্রাণী ও তরুলতার জন্ম বা মৃত্যু ঘটে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ুতে যেসব প্রাণী বেঁচে ছিল তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের মধ্যে অনেক প্রাণীরই বিলুপ্তি ঘটেছে। প্রকৃতির মধ্যে সব প্রাণীর অস্তিত্ব, বংশবিস্তার ও বিবর্তন ভারসাম্যপূর্ণভাবে ঘটে চলেছে। প্রাণীরা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সবুজ গাছপালা বাতাসে যে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিচ্ছে তা গ্রহণ করে প্রাণীরা বেঁচে থাকে। আবার প্রাণীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন পায় গাছপালা। বনে বিভিন্ন প্রাণী একে অন্যকে শিকার করে বেঁচে থাকে। প্রাণীদের বংশবিস্তার ঘটে একই নিয়মে। ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের প্রাণী ও গাছপালার ক্ষতি হয়, আবার প্রকৃতির নিয়মেই সুন্দরবন গাছপালা ও প্রাণীতে পূর্ণ হয়ে উঠে।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের অবস্থা : বাংলাদেশে একসময় প্রচুর বনজঙ্গল, জীবজন্তু ও পশুপাখি ছিল। নিচু জলাভূমিতে ছিল প্রচুর জলচর প্রাণী। দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শহর নির্মিত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের উপর যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে । ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে জলচর প্রাণী ও মাছের বংশবিস্তারে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।

ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শহর-গঞ্জ গড়ে উঠার ফলে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে গেছে। যেখানে সেখানে শিল্প-কারখানা তৈরি হওয়ার ফলে কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা। বেশি মানুষের জন্য বেশি খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মাছ, পোকা-মাকড় ও পাখির বংশবিস্তার। তাতেও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।

দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে গাছপালা, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য সম্পদের উপর চাপ পড়ছে। শহরে গ্যাস ও পানি সরবরাহ কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলেও গাছপালা কমে যাওয়ায় সেখানেও তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার পরিণতি আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর হবে। এই বিপদ মোকাবিলায় এখনই আমাদের সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।

জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য করণীয়সমূহ:
• জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে;
• কৃষি জমি নষ্ট করা যাবে না;
• কৃষি উৎপাদনে জীববৈচিত্র্য রক্ষার নীতি অনুসরণ করতে হবে;
• রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে;
• স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করা যাবে না;
• জলাধার নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে হবে;
• রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে নিয়ম মেনে চলতে হবে;
• খনিজ সম্পদ ব্যবহারে প্রাকৃতিক নিয়ম মানতে হবে;
• বনজ সম্পদ বাড়াতে হবে এবং দেশে আরও বন সৃষ্টি করতে হবে;
• পশু ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধি করতে হবে;
• জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে; মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সর্বোচ্চ হুমকির মুখে রয়েছে।

কাজ : বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের বাস্তব অবস্থার চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করো।

Content added By

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত শিল্প। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (GDP) এ খাতের অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। নিচে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্পের বিবরণ দেওয়া হলো:

পাট শিল্প : ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জে আদমজি পাটকল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ দেশে একসময় প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট বিক্রি করে কৃষক তার পরিবারের টাকার চাহিদা পূরণ করত। একসময় পাটকলগুলো শুধু পাটের বস্তা উৎপাদন করত। এখন পাট দিয়ে নানা পণ্য-সামগ্রী উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে।

বস্ত্র শিল্প : ১৯৪৭ সালে এদেশে মাত্র ৮টি বস্ত্রকল ছিল। বর্তমানে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর বস্ত্র ও সুতাকল রয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম মূলধন ও অধিক শ্রমিক ব্যবহার করে এ শিল্পের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বস্ত্ৰ শিল্পের প্রাধান্য ছিল।

পোশাক শিল্প : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত শতকের আশির দশকে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। অতি অল্প সময়ে এ শিল্পটি দেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক পোশাক শিল্প ইউনিট রয়েছে। এতে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। বাংলাদেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে।

চিনি শিল্প : বাংলাদেশে প্রচুর আখের চাষ হয়। আখ থেকে চিনি ও গুড় তৈরি হয়। ১৯৩৩ সালে নাটোরের গোপালপুরে প্রথম চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশে ১৭টি চিনিকল আছে। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী চিনি দেশে উৎপাদিত হয় না। ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর প্রচুর চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

কাগজ শিল্প : ১৯৫৩ সালে চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী কাগজের কল স্থাপিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশে কাগজ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় বাঁশ ও বেতকে ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়। দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারিখাতে বেশ কয়েকটি কাগজের কল রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে কর্ণফুলী, পাকশী, খুলনা হার্ডবোর্ড ও নিউজপ্রিন্ট মিল ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে বসুন্ধরা ও মাগুরা পেপার মিল উল্লেখযোগ্য কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠান।

সার শিল্প : কৃষি প্রধান বাংলাদেশে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই রাসায়নিক সার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬১ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক সার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় । দেশে এখন ৮টি সার কারখানা চালু আছে। বাংলাদেশের সারের চাহিদা পূরণের জন্যে এ কয়টি কারখানার উৎপাদন যথেষ্ট নয়। প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমাদের প্রচুর সার আমদানি করতে হচ্ছে।

সিমেন্ট শিল্প : পাকা বাড়িঘর, দালান কোঠা তথা শহর নির্মাণে প্রচুর সিমেন্টের প্রয়োজন হয় ৷ চুনাপাথর ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সমন্বয়ে সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। ১৯৪০ সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে সিমেন্ট শিল্পের যাত্রা শুরু হয় । বর্তমানে বাংলাদেশে বড় ও মাঝারি আকারের ১২টি সিমেন্ট কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় দেশের মোট চাহিদার অর্ধেক সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। বাকি সিমেন্ট আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

ঔষধ শিল্প : বাংলাদেশে বর্তমানে ঔষধ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। এক সময় আমাদেরকে প্রচুর অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে ঔষধ আমদানি করতে হতো। এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ঔষধ কোম্পানি তৈরি হয়েছে যারা দেশের ঔষধ চাহিদার অনেকটাই পূরণ করছে, একই সঙ্গে বিদেশে ঔষধ রপ্তানিও করছে। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প হিসাবে ঔষধের সম্ভাবনার কথা সকলেই এখন গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে।

চামড়া শিল্প : বাংলাদেশে প্রচুর গরু, ছাগল ও মহিষ পালন করা হয়। এদেশে বহু আগে থেকেই চামড়া বা টেনারি শিল্প গড়ে উঠেছে। জুতা ও ব্যাগ তৈরিতে চামড়া শিল্পের জুড়ি নেই। এখন বাংলাদেশে কিছুসংখ্যক চামড়া শিল্প কারখানা তৈরি হয়েছে যেগুলো দেশের গরু, ছাগল ও মহিষের চামড়া থেকে জুতা, ব্যাগসহ নানা উন্নতমানের জিনিস তৈরি করছে। কোনো কোনো কোম্পানি বিদেশেও তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করছে।

চা শিল্প : চা বাংলাদেশের অতি পুরাতন শিল্পের মধ্যে একটি। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর চা উৎপাদিত হয়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে বর্তমানে চায়ের চাষ হচ্ছে। চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তা পানের উপযোগী করা হয়। বাংলাদেশ নিজেদের চায়ের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করে থাকে।

তুলা : তুলা বাংলাদেশে একটি নতুন অর্থকরী ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে তুলার চাষ শুরু হয়েছে। এদেশের জলবায়ু ও মৃত্তিকা তুলা চাষের উপযোগী। তবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম বলে প্রয়োজনীয় তুলার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

চিংড়ি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশে চিংড়ি অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য। তাই চিংড়িকে বাংলাদেশের ‘সাদা সোনা' বলা হয় ।

এছাড়া বাংলাদেশে নানা ধরনের ছোট ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা তৈরি হচ্ছে। ঐসব কারখানা থেকে বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী তৈরি হচ্ছে যা আমাদের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

কাজ : বাংলাদেশের শিল্পখাতের তালিকা প্রণয়ন করে এগুলোর গুরুত্ব চিহ্নিত করো।

Content added || updated By

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিল্পের অবদান

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিল্প: বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অত্যন্ত দ্রুত শিল্পায়ন ঘটছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের পণ্য-সামগ্রী তৈরি করছে। সেইসব পণ্য নিয়ে তারা ব্যবসা- বাণিজ্য করছে, জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। শিল্পের বিকাশে মানুষের উদ্যোগ, পুঁজি এবং গবেষণা ও অভিজ্ঞতাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। এখন সকল রাষ্ট্রই দ্রুত শিল্পায়ন ঘটানোর জন্যে উদার নীতিমালা প্রণয়ন করছে। দেশি বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজ দেশে পুঁজি বিনিয়োগ ও শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটছে। অর্থনৈতিক উন্নতিই দেশের জনগণের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করে। সে কারণে দ্রুত দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন বা উন্নতি ঘটাতে হলে শিল্প বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। এমন কি কৃষি বা সেবা খাতেও উন্নতি করতে হলে শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। সেইসব খাতও এখন যন্ত্রপ্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যাপক উন্নতি লাভ করছে। ফলে কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও এখন শিল্পায়নের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে । শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন কৃষক অধিক ফসল ফলাচ্ছে, নিজের চাহিদাপূরণ করেও বাজারে ফসল বিক্রি করে নিজের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে পারছে। ফলে সামাজিকভাবে কৃষকের জীবনযাত্রা এখন আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে শিল্প বিকাশের প্রভাব : বাংলাদেশে জনসংখ্যার চাপ অত্যন্ত বেশি। সব মানুষকে একমাত্র কৃষি স্বচ্ছলতা দিতে সক্ষম নয়। এ অবস্থায় কল-কারখানায় কাজ করে শ্রমজীবীদের পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচানো সম্ভব হচ্ছে। অনেকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভালো বেতনে চাকরি করছে। এভাবে কৃষির বাইরেও অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে একমাত্র গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গেই এখন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ জড়িত আছে। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক হলো নারী-যারা নিজেদের দারিদ্র্য ঘোচাতে গার্মেন্টসে যুক্ত হয়েছে। তারা স্বাবলম্বী মানুষ হিসাবে গড়ে উঠেছে। অনেকেই কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণ নিয়ে অধিকতর দক্ষতা অর্জন করছে। নিজেদের সন্তানদের তারা লেখাপড়ার মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

শুধু গার্মেন্টসে নয়, অন্যান্য খাতেও গ্রাম থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবিকার সংস্থান করছে। এভাবে শিল্প ও প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে তারা যেমন একদিকে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সামাজিকভাবেও তারা নতুন আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্ঞান- বিজ্ঞানের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। এতে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। শহরে অতি দরিদ্রের চেয়ে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাকরি, ব্যবসা- বাণিজ্য, শিক্ষকতা, আইন-ব্যবসাসহ নতুন নতুন পেশায় মানুষ যুক্ত হচ্ছে। মানুষ এভাবে শিল্প ও প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে আর্থ-সামাজিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলছে তাকে আমরা সংক্ষেপে আধুনিক জীবন ব্যবস্থা বলছি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো শিল্পের উন্নতি ঘটিয়েই উন্নত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এখন শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের দ্রুত প্রসার ঘটিয়ে আমরাও উন্নত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

কাজ : শিল্প বিকাশের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করো।

Content added || updated By
Promotion